মুনীরুল ইসলাম ইবনু যাকির: চন্দ্র ও সূর্য আল্লাহর সৃষ্টি। এরই প্রমাণস্বরূপ আল্লাহ এ দুটোর ওপর ‘গ্রহণ’ প্রদান করেন। এটি আল্লাহর শক্তিমত্তার নিদর্শন বৈ কিছুই নয়। চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ তার পূজারিদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ সতর্কবাণী পৌঁছে দেয় যে, এ দুটোও অন্যান্য সৃষ্টির মতো আল্লাহর এক সৃষ্টি। এরা উপাসনার যোগ্য নয়। যেহেতু এরা নিজেরাই বিপদগ্রস্ত হয়, যা থেকে নিজেরা আত্মরক্ষা করতে পারে না, সেহেতু এগুলো উপাসনার যোগ্য হতে পারে না। বরং এ দুটোকে আল্লাহকে চেনার নিদর্শন হিসেবে গণ্য করাই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। মহান আল্লাহ বলেছেন,
وَمِنْ آيَاتِهِ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ لَا تَسْجُدُوا لِلشَّمْسِ وَلَا لِلْقَمَرِ وَاسْجُدُوا لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَهُنَّ إِن كُنتُمْ إِيَّاهُ تَعْبُدُونَ
‘আর তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে রয়েছে দিবস, রজনী, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না; সিজদা করো আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা নিষ্ঠার সাথে শুধুমাত্র তাঁরই ইবাদত কর। [সুরা ফুসসিলাত, ৪১ : ৩৭]
জাহিলি যুগে মানুষ ধারণা করত যে, বিশ্বে কোনো মহাপুরুষের জন্ম, মৃত্যু কিংবা দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতির বার্তা দিতে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয়ে থাকে। ইসলাম একে ভ্রান্ত ধারণা আখ্যায়িত করেছে এবং ‘গ্রহণ’ কে সূর্য ও চন্দ্রের ওপর একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল বা বিপদের সময় বলে গণ্য করেছে। এ জন্য সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের সময় মুমিনদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন এ সময়ে অন্যান্য কাজকর্ম বন্ধ রেখে আল্লাহর জিকির, তাসবিহ, দুয়া, সালাত প্রভৃতি আমল করে।
হাদিসের আলোকে চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ
১. মুগিরা ইবনু শুবা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনটিতেই সূর্যগ্রহণ হল। তখন আমরা সকলে বলাবলি করছিলাম যে, নবিপুত্রের মৃত্যুর কারণেই এমনটা ঘটেছে। আমাদের কথাবার্তা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘সুর্য এবং চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শনের মধ্যে দুটি নিদর্শন। কারোর মৃত্যু কিংবা জন্মগ্রহণের ফলে চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ হয় না।’ [বুখারি, আসসাহিহ : ১০৪৩; মুসলিম, আসসাহিহ : ৯১৫]
২. আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় একবার সূর্যগ্রহণ হলো। গ্রহণ শুরু হবার সাথে সাথে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্রুত মসজিদের দিকে ধাবিত হলেন এবং সকলকে মসজিদে আসতে আহবান জানালেন। তিনি নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ করলেন যে এই জামায়াতে আগে কখনো এমন করেননি। এরপর রুকুতে গেলেন এবং রুকু এত দীর্ঘ করলেন যা আগে কখনো করেননি। এরপর দাঁড়ালেন কিন্তু সিজদায় গেলেন না এবং দ্বিতীয় রাকায়াতেও কিরায়াত দীর্ঘ করলেন। এরপর আবার তিনি রুকুতে গেলেন এবং তা পূর্বের চেয়ে আরও দীর্ঘ করলেন। রুকু সমাপ্ত হলে দাঁড়ালেন এবং এরপর সিজদায় গেলেন এবং তা এত দীর্ঘ করলেন যে, আগে কখনো এমনটা করেননি। এরপর সিজদা থেকে দাঁড়িয়ে প্রথম দু’রাকায়াতের ন্যায় দ্বিতীয়বারও ঠিক একইভাবে নামাজ আদায় করলেন। ততক্ষণে সূর্যগ্রহণ শেষ হয়ে গেছে। নামাজ সমাপ্ত হলে তিনি আল্লাহর প্রশংসা পেশ করে খুতবা প্রদান করলেন। তিনি বললেন, ‘সূর্য এবং চন্দ্র আল্লাহর অগণিত নিদর্শনসমূহের মধ্যে দু’টো নিদর্শন। কারো মৃত্যু কিংবা জন্মগ্রহণের ফলে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না। অতএব, যখনই তোমরা চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ প্রত্যক্ষ করবে তখনই আল্লাহকে ডাকবে, তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করবে এবং নামাজে রত হবে। [বুখারি, আসসাহিহ : ১০৪৪; মুসলিম, আসসাহিহ : ৯০১]
৩. আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ছিলাম। এ সময় সূর্যগ্রহণ শুরু হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের চাদর টানতে টানতে মসজিদে প্রবেশ করলেন এবং আমরাও প্রবেশ করলাম। তিনি আমাদেরকে নিয়ে সূর্য প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত দু’রাকাত নামাজ আদায় করলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘কারো মৃত্যুর কারণে কখনো সূর্যগ্রহণ কিংবা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তোমরা যখন সূর্যগ্রহণ দেখবে তখন এ অবস্থা কেটে যাওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করবে এবং দুয়া করতে থাকবে।’ [বুখারি, আসসাহিহ : ৯৮৩]
৪. নুমান ইবনু বাশির (রা.) সূত্রে নবি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে বর্ণিত যে, তিনি একদিন অতি দ্রুত মসজিদ অভিমুখে বের হয়ে গেলেন, তখন সূর্যগ্রহণ লেগে গিয়েছিল। তারপর এমনভাবে নামাজ আদায় করলেন যে, সূর্য আলোকিত হয়ে গেল। তারপর তিনি বললেন, ‘জাহিলি যুগের লোকেরা বলত যে, কোন মহান ব্যক্তির মৃত্যু ব্যতীত চন্দ্র-সৃর্যের গ্রহণ হয় না। অথচ কারো জন্ম মৃত্যুর কারণে চন্দ্র-সূর্যের গ্রহণ হয় না, বরং তারা আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুসমূহের দুটি বস্তু। আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্টিতে যা যা ইচ্ছা নব নব সৃষ্টি করেন। অতএব সূর্য এবং চন্দ্রের কারো যদি গ্রহণ লেগে যায়, তবে তোমরা নামাজ আদায় করতে থাকবে, তা আলোকিত হওয়া অথবা আল্লাহ তায়ালার নতুন কোন ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত।’ [নাসায়ি, আসসুনান : ১৪৯৩]
৫. আবু মুসা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে একবার সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। তখন তিনি ওঠে দাঁড়ালেন এ আশংকায় যে, কিয়ামতের মহাপ্রলয় বুঝি সংঘটিত হবে। তিনি দ্রুত মসজিদে এলেন। অত্যন্ত দীর্ঘ কিয়াম, দীর্ঘ রুকু ও দীর্ঘ সিজদার সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন। আমি আর কোন নামাজে কখনো এরূপ দেখিনি। এরপর তিনি বললেন, ‘আল্লাহর প্রেরিত এসব নিদর্শনাবলি কারো মৃত্যুর জন্য হয় না, কারো জন্মের জন্যও হয় না। বরং তিনি এগুলো প্রেরণ করেন তাঁর বান্দাদের সতর্ক করার জন্য। যখন তোমরা এসব নিদর্শনাবলির কিছু দেখতে পাও, তখন তোমরা আতংকিত হৃদয়ে আল্লাহর জিকির, দুয়া ও ইস্তিগফারের মশগুল হও।’ [মুসলিম, আসসাহিহ : ১৯৮৯]
আমাদের উচিত যা কিছু কুরআন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহিহ হাদিসে রয়েছে সে সম্পর্কে জানা ও সে অনুযায়ী আমল করা এবং সমস্ত কুসংস্কার ও জাহিলিয়াতকে বর্জন করা।